নিউটনের ভুল সূত্ৰ

Story | By PRiNCE

কীসের পরীক্ষা?
কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।
অঙ্ক পারি না যে।
অঙ্ক না পারার কি আছে? যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ-অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।
তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।
রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যানমাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেশেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।
নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?
নদিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে লিখেছেন–
জনাব,
আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।
যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে মনে ভাবছেন-শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনিই আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।
বিনীত
এস. আলি
M. Sc., Ph. D. F.R.S.
অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দুএকটা ছোটখাটো পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,
হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।
তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।
আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্ৰজ্বলিত কর। পথ দেখাও পরম পিতা।
আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হল না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হত লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গতকাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এই সব কি লেখা?
অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, প্রার্থনা সংগীত।
প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?
শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এই জন্যে।
লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?
অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?
জ্বি-না।
আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।
আমার শরীর যা আছে তাই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।
এইসব কি ধরনের কথা? কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?
জ্বি-না।
ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কিভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম. এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান টেনে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?
জ্বি স্যার, থাকবে।
না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?
একটু বসুন স্যার।
হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু এক দৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার—যদি কিছু মনে না করেন।
বলুন কি বলবেন। মনে করাকরির কি আছে?
অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শূন্যে ভাসতে পারি।
বুঝতে পারলাম না কি বলছেন। আমি আপনা-আপনি শূন্যে উঠে যেতে পারি।
ও আচ্ছা।
হেড মাস্টার সাহেব ও আচ্ছা এমন ভঙ্গিতে বললেন, যেন শূন্যে ভেসে থাকবার ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত বোধ করছেন।
ছাদের লেখাগুলি শূন্যে ভাসতে ভাসতে লেখা।
ও আচ্ছা।
আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
হেড মাস্টার সাহেব জবাব দিলেন না। অমর বাবু বললেন, আমি স্যার এই জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। ছেলেবেলায় হয়তো বলেছি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলিনি।
আমি বিধু বাবুকে পাঠিয়ে দেব।
জি আচ্ছা।
হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, উনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা বলার দরকার নেই। জানাজানি হবে-ইয়ে মানে—লোকজন হাসাহাসি করতে পারে।
আমি আপনাকেই খোলাখুলি বলেছি। আর কাউকে বলিনি।
ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।
বিধু বাবু এসে খানিকক্ষণ গল্পটল্প করে যাবার সময় ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, দুঃস্বপ্ন না দেখার একটাই পথ। গভীর নিদ্রা। দ্রিা পাতলা হলেই মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ফোনোবারবিটন ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। শোবার আগে দুটা করে খাবেন।
অমর বাবু দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তবে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাণ্ড করলেন-কালিপদকে বললেন, লম্বা একাছি দড়ি নিয়ে তাঁকে খুব ভালো করে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখতে।
কালিপদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।
অমর বাবু বিরক্ত মুখে বললেন, আমার মাথা খারাপ হয়নি। মাথা ঠিক আছে। তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ব্যাপারটা কি পরে বুঝিয়ে বলব। লম্বা দেখে একগাছি দড়ি আন। শক্ত করে আমাকে চৌকির সঙ্গে বাঁধ।
কালিপদ তাই করল। তবে করল খুব অনিচ্ছার সঙ্গে।
অমর বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণে তাঁর গাঢ় দ্রিা হল। ঘুম ভাঙল বেলা উঠার পর। তিনি দেখলেন—এখনো চৌকির সঙ্গে বাঁধা আছেন তবে চৌকি আগের জায়গায় নেই, ঘরের মাঝামাঝি চলে এসেছে। তার একটিই মানে—চৌকি নিয়েই তিনি শূন্যে ভেসেছেন। নামার সময় চৌকি আগের জায়গায় নামেনি। স্থান পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি সেদিনই বিছানাপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। অতসী তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, নাকে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?
অতসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা? কী ভয়ংকর রোগা হয়ে গেছে।
ভালো ঘুম হচ্ছে না, এই জন্যে শরীর খারাপ হয়েছে, এতে নাকে কাদার কি হল?
সবাই বলাবলি করছে তোমার না-কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কালিপদ নাকি রোজ রাতে দড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখে।
কী যন্ত্রণা! একবারই বাঁধতে বলেছিলাম—এর মধ্যে এই গল্প ছড়িয়ে গেছে?
তোমার কী হয়েছে বাবা বল?
কিছু হয়নি।
অমর বাবু ছদিন বাড়িতে থাকলেন। এই ছদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলেন। শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা তিনি একা একা থাকার সময়ই ঘটে। অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ঘুমুলে ঘটে না। যে কত তাঁর স্ত্রী তাঁর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন সে করাত তিনি শূন্যে ভাসেননি। দুরাত ছিলেন একা একা, দুরাতেই শূন্যে উঠে গেছেন।
পূজার ছুটির পর স্কুল নিয়মিত শুরু হল। তিনি স্কুলে গেলেন না। লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলেন। আবার বাড়ি ছেড়ে বাস করতে শুরু করলেন স্কুলের ঘরে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না।
শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা রোজ ঘটতে লাগল। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে লাগল। এখন বিছানায় শোয়ামাত্র শূন্যে উঠে যান। সারারাত সেখানেই কাটে। শেষ রাতের দিকে নিচে নেমে আসেন। ব্যাপারটা ঘটে শুধু রাতে, দিনে ঘটে না। কখনো না। এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সামনেও ঘটে না।
হেড স্যার এবং ইদরিস স্যার পর পর দুরাত অমর বাবুর ঘরে জেগে বসে ছিলেন। দেখার জন্যে ব্যাপারটা কি। তাঁরা মুহুর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করেননি। লাভ হয়নি, কিছুই দেখেননি। হেড স্যার বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক।
অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনার কি ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি?
না, তা না। পাগল হবেন কেন? তবু আমার ধারণা ব্যাপারটা আপনার মনে ঘটছে। একবার ঢাকায় চলুন না, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি।
না।
ক্ষতি তো কিছু নেই। চলুন না।
আমি যেতে চাচ্ছি না স্যার, কারণ আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। সত্যি না হলে ছাদে এই লেখাগুলি আমি কীভাবে লিখলাম? দেখছেন তো ঘরে কোনো মই নেই।
হেড স্যার চুপ করে রইলেন। অমর বাবু বললেন, আপনারা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আবার শূন্যে উঠে ছাদে একটা লেখা লিখব।
হেড স্যার বললেন, তার দরকার নেই; কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি আমাদের সামনে ব্যাপারটা পারছেন না কেন?
আমি জানি না। জানলে বলতাম। জানার চেষ্টা করছি, দিন-রাত এটা নিয়েই ভাবছি।
এত ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলুন। দুদিনের ব্যাপার। যাব, ডাক্তার দেখাব, চলে আসব। আমার একটা অনুরোধ রাখুন। প্লিজ। আপনার হয়তো লাভ হবে না কিন্তু ক্ষতি তো কিছু হবে না।

অমর বাবু ঢাকায় গেলেন।
একজন অতি বিখ্যাত মনোররাগ বিশেষজ্ঞ দীর্ঘ সময় ধরে তাঁকে নানান প্রশ্ন করলেন। পরপর কয়েকদিন তার কাছে যেতে হল। শেষ দিনে বিশেষজ্ঞ
ভদ্ৰলোক বললেন,
আপনার যা হয়েছে তা একটা রোগ। এর উৎপত্তি হচ্ছে অবসেসনে। বিজ্ঞানের প্রতি আপনার তীব্র অনুরাগ। সেই অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছে অবসেসনে। কেউ যখন বিজ্ঞানকে অবহেলা করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলে তখন আপনি তীব্র আঘাত পান। এই আঘাত আপনি পেয়েছেন আপনার অতি নিকটজনের কাছ থেকে। যেমন ধরুন আপনার কন্যা। সে বিজ্ঞান পড়েনি। আর্টস পড়ছে। এই তীব্র আঘাত আপনার মন গ্রহণ করতে পারেনি। আপনার অবচেতন মন ভাবতে শুরু করেছে—বিজ্ঞানের সূত্র অভ্রান্ত নয়। ভুল সূত্বও আছে। মাধ্যাকর্ষণ সূত্রও ভুল। এক সময় অবচেতন মনের ধারণা সঞ্চারিত হয়েছে চেতন মনে। বুঝতে পারছেন?
জ্বি না, বুঝতে পারছি না।
মোদ্দা কথা হল, আপনার রোগটা মনে।
না—আমি নিজে বিজ্ঞানের শিক্ষক। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বিবেচনা করেছি। আমি যে শূন্যে উঠতে পারি এটা ভুল না। পরীক্ষিত সত্য।
মোটেও পরীক্ষিত সত্য নয়। আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি দেখেনি যে আপনি শূন্যে ভাসছেন। দেখলেও কথা ছিল, কেউ কি দেখেছে?
জ্বিনা।
আমি ট্ৰাংকুলাইজার জাতীয় কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন, ব্যায়াম করবেন। মন প্ৰফুল্ল রাখবেন। বিজ্ঞান নিয়ে কোনো পড়াশোনা করবেন না।
অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি; কিন্তু আমি যা বলছি সত্য বলছি।
ব্যাপারটা হয়তো আপনার কাছে সত্যি। কিন্তু সবার কাছে নয়। আপনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করলেও এই সিদ্ধান্তে আসবেন।
অমর বাবু ভগ্নহৃদয়ে রূপেশ্বরে ফিরে এলেন। স্কুলে যোগ দিলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মাথা খারাপের সব লক্ষণ তার মধ্যে একে একে দেখা দিতে লাগল। বিড়বিড় করে কথা বলেন, একা একা হাঁটেন। হাঁটার সময় দৃষ্টি থাকে আকাশের দিকে। নিতান্ত অপরিচিত কাউকে দেখলে থমকে দাঁড়িয়ে যান, শান্ত গলায় বলেন, কিছু মনে করবেন না। আপনি কি নিউটনের গতিসূত্র জানেন?
পাগলের অনেক রকম চিকিৎসা করানো হল। কোনো লাভ হল না। বরং লক্ষণগুলি আরো প্রকট হওয়া শুরু করল। গভীর রাতে ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে উঁচু গলায় ডাকেন—জব্বার, ও জব্বার, ওঠে আয় তো বাবা। খুব দরকার।
জব্বার উঠে এলে তিনি করুণ গলায় বলেন, নিউটনের সূত্র মনে আছে? ভালো করে পড়। এস.এস, সি তে আসবে। সাথে অঙ্ক থাকবে ভূমি থেকে দশ ফুট উচ্চতায় ১ গ্রাম ভর বিশিষ্ট একটি আপেল ছাড়িয়া দিলে তার গতিবেগ পাঁচ ফুট উচ্চতায় কত হইবে? অঙ্কটা চট করে কর। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত মনে আছে তো?
আমাদের সমাজ পাগলদের প্রতি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। অমর বাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। বছর খানিক না ঘুরতেই দেখা গেল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে বলছে—নিউটনের সূত্রটা কি যেন? অমর বাবু দাঁতমুখ খিচিয়ে এদের তাড়া করছেন। তারা মজা পেয়ে খুব হাসছে। কারণ তারা জানে পাগলরা শিশুদের তাড়া করে ঠিকই কখনো আক্রমণ করে না।
পৌষের শুরু। জঁকিয়ে শীত পড়েছে। এই শীতেও খালি গায়ে শুধু একটা ধুতি কোমরে পেঁচিয়ে অমর বাবু রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন। নিউটনের সূত্র মনে আছে কিনা এই প্রশ্ন তিনি এখন আর কোনো মানুষকে করেন না। পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গদের করেন। তারা প্রশ্নের উত্তর সঙ্গত কারণেই দেয় না। তিনি তখন ক্ষেপে যান।
রাত দশটার মতো বাজে। কনকনে শীত।
অমর বাবু দাঁড়িয়ে আছেন একটা কাঁঠাল গাছের নিচে। কাঁঠাল গাছের ডালে কয়েকটা বাদুড় ঝুলছে। তিনি বাদুড়গুলিকে নিউটনের সূত্র সম্পর্কে বলছেন। তখনই দেখা গেলহারিকেন হাতে হেড স্যার আসছেন। কাঁঠাল গাছের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। অমর বাবুর দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললেন, কে অমর?
জ্বি স্যার।
কী করছেন?
বাদুড়গুলির সঙ্গে কথা বলছিলাম স্যার।
ও আচ্ছা।
এদের সঙ্গে কথা বললে মনটা হালকা হয়। ওদের নিউটনের সূত্রগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম।
এই শীতে বাইরে ঘুরছেন। বাসায় গিয়ে ঘুমান।
ঘুম আসে না স্যার।
হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ইয়ে অমর বাবু, এখনো কি আপনি শূন্যে ভাসেন?
জ্বি-না। ঢাকা থেকে আসার পর আর ভাসিনি। যদি আবার কখনো ভাসতে পারি–আপনাকে বলব। আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভাসতে ভাসতে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।
দূরে কোথায়?
মহাশূন্যে—অসীম দূরত্বে। চন্দ্ৰ সূৰ্য গ্ৰহ নক্ষত্র সব ছাড়িয়ে…
ও আচ্ছা।
যাবার আগে আমি আপনাকে খবর দিয়ে যাব।
আচ্ছা।

শীত কেটে গিয়ে বর্ষা এসে গেল। অমর বাবু লোকালয় প্রায় ত্যাগ করলেন। বেশির ভাগ সময় বনে-জঙ্গলে থাকেন। রূপেশ্বরের পাশের গ্রাম হলদিয়ায় ঘন বন আছে। এখন ঐ বনেই তাঁর আস্তানা। তাঁর মেয়ে অতসী প্রায়ই তাঁকে খুঁজতে আসে। পায় না। মেয়েটা বনে বনে ঘুরে এবং কাঁদে। তিনি চার-পাঁচদিন পর পর একবার বের হয়ে আসেন। তাঁকে দেখে আগের অমর বাবু বলে চেনার কোনো উপায় নেই। যেন মানুষ না-প্ৰেত বিশেষ। মাথাভর্তি বিরাট চুল, বড় বড় দাড়ি। হাতের নখগুলি বড় হতে হতে পাখির ঠোটের মতো বেঁকে গেছে। স্বভাব-চরিত্র হয়েছে ভয়ংকর। মানুষ দেখলে কামড়াতে আসেন। ইট-পাথর ছুড়েন। একবার স্থানীয় পোস্ট মাস্টারকে গলা টিপে প্রায় মেরে ফেলতে বসেছিলেন। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। অতসীর বিয়ে হয়ে গেছে, সেও এখন আর বাবার খোঁজে আসে না।
দেখতে দেখতে এক বছর পার হয়ে গেল। কার্তিক মাস। অল্প অল্প শীত পড়ছে। এগারোটার মতো বাজে। হেড স্যার খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছেন, হঠাৎ শুনলেন উঠান থেকে অমর বাবু ডাকছেন—স্যার, স্যার-স্যার জেগে আছেন?
কে?
স্যার আমি অমর। একটু বাইরে আসবেন?
হেড স্যার অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তাঁর স্ত্রী বললেন, খবরদার, তুমি বেরুতে পারবে না। পাগল মানুষকি না কি করে বসে। ঘুমাও।
অমর বাবু আবার কাতর গলায় বললেন, একটু বাইরে আসুন স্যার খুব দরকার। খুব বেশি দরকার।
হেড স্যার ভয়ে ভয়ে বাইরে এলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বাড়ির সামনের আমগাছের সমান উচ্চতায় অমর বাবু ভাসছেন। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দৃশ্য। একটা মানুষ অবলীলায় শূন্যে ভাসছে। তার জন্যে পাখিদের মতো তাঁকে ডানা ঝাল্টাতে হচ্ছে না।
স্যার দেখুন আমি ভাসছি।
হেড স্যার জবাব দিতে পারছেন না। প্রথম কয়েক মুহূর্ত মনে হচ্ছিল চোখের ভুল। এখন তা মনে হচ্ছে না। ফকফকা চাঁদের আলো। দিনের আলোর মতো সব দেখা যাচ্ছে। তিনি পরিষ্কার দেখছেন—অমর বাবু শূন্যে ভাসছেন। এই তো ভাসতে ভাসতে খানিকটা এগিয়ে এলেন। সাঁতার কাটার মতো অবস্থায় মানুষটা শুয়ে আছে। কী আশ্চর্য।
স্যার দেখতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আজ হঠাৎ করে শূন্যে উঠে গেলাম। বন থেকে বের হয়ে রূপেশ্বরের দিকে। আসছি হঠাৎ শরীরটা হালকা হয়ে গেল। দেখতে দেখতে দশ-বারো ফুট উঠে গেলাম। প্রথমেই ভাবলাম আপনাকে দেখিয়ে আসি। ভাসতে ভাসতে আসলাম।
আর কেউ দেখেনি?
না। কয়েকটা কুকুর দেখেছে। ওরা ভয় পেয়ে খুব চিৎকার করছিল। এরকম দেখে তো অভ্যাস নেই। আপনার কি বিশ্বাস হচ্ছে স্যার?
হ্যাঁ, হচ্ছে। আমি ঠিক করেছিভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে মিলিয়ে যাব।
ও আচ্ছা।
আমার মাথাটা বোধ হয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল সারাক্ষণ ব্যথা করত। এখন ব্যথাও নেই। আগে কাউকে চিনতে পারতাম না। এখন পারছি।
শুনে ভালো লাগছে অমর বাবু।
অন্য একটা কারণেও মনে খুব শান্তি পাচ্ছি। কারণটা বলি—মহাশূন্যে ভাসার রহস্যটাও ধরতে পেরেছি।
হেড মাস্টার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রহস্যটা কী?
রহস্যটা খুব সাধারণ। এতদিন কেন ধরতে পারিনি কে জানে। তবে স্যার আপনাকে রহস্যটা বলব না। বললে আপনি শিখে যাবেন। তখন দেখা যাবে সবাই শূন্যে ভাসছে। এটা ঠিক না। প্রকৃতি তা চায় না। স্যার যাই?
অমর বাবু উপরে উঠতে লাগলেন। অনেক অনেক উঁচুতে। এক সময় তাঁকে কালো বিন্দুর মতো দেখাতে লাগল।
হেড স্যারের স্ত্রী হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে ভীত গলায় বললেন, কি ব্যাপার? পাগলটা কোথায়?
চলে গেছে।
তুমি বাইরে কেন? ভেতরে এসে ঘুমাও।
তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন।
অমর বাবুকে এর পর আর কেউ এই অঞ্চলে দেখখনি। হেড স্যার সেই রাত্রির কথা কাউকেই বলেননি। কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। সবাই পাগল ভাববে। আর একবার পাগল ভাবতে শুরু করলে শেষ পর্যন্ত পাগল হতেই হয়—এটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন।
--হুমায়ূন আহমেদ


0 COMMENTS | 2 mon, 4 w

Please Login to Add a comment